বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী সেরা কিছু গুজবের মধ্যে অন্যতম হলো সুনীতা উইলিয়ামসের ইসলাম গ্রহণ। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় সংবাদপত্র দৈনিক কালের কণ্ঠ কোন প্রকার সত্যতা যাচাই না করেই এই সংবাদটি পরিবেশন করে গত 16 মার্চ তারিখে। সংবাদটি হুবহু এখানে তুলে ধরা হলোঃ
মুসলমান হওয়ার গল্প-১ :
নাসার নভোচারী সুনিতা এখন মুসলমান
২০০৬ সালের কথা। বরাবরের মতো মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা থেকে একটি নভোযান পাঠানো হলো। মহাকাশের খোঁজখবর সংগ্রহ করাই ছিল যে অভিযানের মূল উদ্দেশ্য। অন্য গবেষকদের সঙ্গে সে নভোযানে অবস্থান করছিলেন সুনিতা উইলিয়াম। মহাকাশ গবেষণাযানটি যখন পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে ২৪০ মাইল উপরে, হঠাৎ নিচের দিকে চোখ আটকে যায় সুনিতার। পৃথিবী পৃষ্ঠে তারার মতো দুটি আলো জ্বলতে দেখলেন তিনি। চিন্তায় পড়ে গেলেন সুনিতা; ভাবলেন, পৃথিবীপৃষ্ঠে তো এভাবে জ্বলে থাকার মতো কোনো আলোকশিখা থাকার কথা নয়। তবে এই আলোকরশ্মি দুটি কি?
সঙ্গীদের ডেকে দেখালেন এবং টেলিস্কোপের সাহায্যে আলো দুটিকে নির্ণয় করার চেষ্টা চালালেন। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো সুনিতার। আরো কাছে, আরো পরিষ্কারভাবে দেখলেন, আলো দুটির কেন্দ্রস্থল পৃথিবীর মক্কা ও মদিনা। মক্কা শহরের কেন্দ্রস্থল ও মদিনা শহরের কেন্দ্রস্থ থেকে মহাকাশমুখি এই আলোকরশ্মি দুটি বিকিরিত হচ্ছে।
মহাকাশ অঙ্গনে ঘটে যাওয়া এই ঘটনা সম্পর্কে সুনিতা উইলিয়াম নিজেই বলেছেন, 'আমি যখন পৃথিবী থেকে প্রায় ২৪০ মাইল উপরে উঠলাম, তখন পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে পৃথিবীপৃষ্ঠে দুটি তারা (আলো) দেখতে পেলাম। এর পর একটি টেলিস্কোপের মাধ্যমে আলো দুটি দেখার চেষ্টা করলে দেখি, একটি আলোর অবস্থান মক্কায় আর অন্যটি মদিনায়। এই দৃশ্য দেখার পর আমি প্রচণ্ডভাবে অভিভূত হই এবং তখনই ইসলাম গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিই। পরে ফিরে এসে ইসলাম গ্রহণ করি। আমি এখন একজন মসলমান।'
ইসলাম গ্রহণ করা নিয়ে শত জল্পনা-কল্পনার ইতি টেনে ওমরাহ পালন করতে আসা সুনিতা উইলিয়াম জেদ্দার হোটেল হিলটনে বসে এভাবেই ব্যক্ত করছিলেন তাঁর ইসলাম গ্রহণ করার কাহিনী। সাংবাদিকদের শোনাচ্ছিলেন তাঁর মুসলমান হওয়ার রোমাঞ্চকর গল্প। এ সময় তিনি ইসলাম গ্রহণ করার নেপথ্যে থাকা ঘটনা ব্যক্ত করার পাশাপাশি উপস্থিত সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নেরও উত্তর দেন। নাসার প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক সুনিতার ইসলাম গ্রহণ করা বিষয়ে তাঁকে চেনেন বা জানেন এমন অনেকের মন্তব্য ছিল অনেকটাই এরকম- 'আর কারো পক্ষে সম্ভব হলেও সুনিতার পক্ষে এটা কখনো সম্ভব নয়।
কারণ সে ছিল ইসলাম বিদ্বেষী'। অবশেষে সব জল্পনা-কল্পনা এবং সন্দেহ-কানাকানির ইতি টেনে গত রমজান মাসে ওমরাহ পালন করতে এসে নিজের মুসলমান হওয়ার ঘোষণা দিলেন সুনিতা উইলিয়াম এবং গর্ব করে বললেন, 'আমি এখন একজন মুসলমান, এটা ভাবতেই আমার ভালো লাগছে।'
ভারতীয় বংশোদ্ভূত সুনিতা উইলিয়াম ১৯৬৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ায়ো অঙ্গরাজ্যের 'ইউক্লিডে' জন্মগ্রহণ করেন। বাবা দীপক পাণ্ডে ও মা বনি পাণ্ডে উভয়ই ছিলেন ভারতীয় হিন্দু। ম্যাসাচুসেটস হাই স্কুলে পড়াশোনা করার পর ১৯৮৭ সালে ফিজিক্যাল সায়েন্সে বিএস ডিগ্রি এবং ১৯৯৫ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজমেন্ট ফ্লোরিডা ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে এমএস ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। এর আগে ১৯৮৯ সালে সুনিতা ন্যাভাল একাডেমীতে কমিশন লাভ করেন এবং ১৯৯৩ সালে ন্যাভাল এভিয়েটর হিসেবে পদোন্নতি অর্জন করেন। পরবর্তী সময়ে আমেরিকান হেলিকপ্টার ইনস্টিটিউটে টেস্ট পাইলট ইঞ্জিনিয়ারের দায়িত্ব পালনকালে ভূমধ্যসাগর, লোহিত সাগর, পারস্য ও আরবসাগরসহ মরুভূমি এলাকায় কাজ করেন। এর পর ১৯৯৮ সালে সুনিতা ফ্লোরিডাস্থ মার্কিন মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র নাসায় যোগদান করেন। কর্মরত অবস্থায়ই একজন ক্যাথলিক খৃস্টানকে বিয়ে করে সংসারজীবনে প্রবেশ করেন তিনি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন সময়, বিশেষ করে আরবের মরু এলাকায় কাজ করার সময় অল্প-বিস্তর ধারণা অর্জন করেন মুসলমানদের প্রকৃত জীবন সম্পর্কে। উল্লেখ্য, এর আগে ইসলাম সম্পর্কে সুনিতার বস্তুত কোনো ধারণা বা পড়াশোনা ছিল না।
নভোযান পরিচালনার ক্ষেত্রে খুব দক্ষ কর্মী ছিলেন সুনিতা উইলিয়াম। মহাকাশে গিয়ে রেকর্ড পরিমাণ সময় ১৯ ঘণ্টা ১৭ মিনিট স্পেস ওয়ার্ক করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে নিঃসন্তান সুনিতা সেদিন সবার সামনে স্পষ্ট ভাষায় বলেন, 'আমি একজন মুসলমান। আমার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা নিয়ে এতদিন যে সন্দেহ চলে আসছিল, আজ তার অবসান হলো। বর্তমানে আমি একজন মুসলমানের মতোই জীবন যাপন করছি। আমার ইসলাম গ্রহণ করার ব্যাপারে আর কোনো বিভ্রান্তি ছড়ানোর উপায় নেই।
প্রতিবেদক: মিরাজ রহমান (ইমেইল: mirajrahmanbd@gamil.com)
প্রকৃতপক্ষে এই প্রতিবেদন হচ্ছে ইন্টারনেট ভিত্তিক অপপ্রচারের ফসল। ইন্টারনেটে কি কি অপপ্রচার হচ্ছে সুনীতাকে ঘিরে? ইন্টারনেট ভিত্তিক মুসলমানদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্যবহুল ওয়েবসাইট উইকিইসলাম ডটনেট হতে এবিষয়ে হুবহু বিবরণটা এই রকমঃ
একজন নারী নভোযাত্রী হিসেবে সুনীতা উইলিয়ামস সবচেয়ে দীর্ঘ সময় (195 দিন) মহাকাশে অবস্থানের রেকর্ডের অধিকারী। তাঁর বাবা ড. দীপক পাণ্ডে একজন হিন্দু, আর মা বনি পাণ্ডে একজন ক্যাথলিক। উইলিয়ামের উভয় ধর্মবিশ্বাসের প্রতিই শ্রদ্ধাবোধ আছে। তবে তিনি একজন গণেশ ভক্ত হিসেবেই পরিচিত।
বিভিন্ন ওয়েবসাইট, ব্লগ, ফোরাম এবং চেইন ইমেইল বা গণ-মুঠোবার্তায় প্রচারণায় দাবি জানানো হয়েছে যে সুনীতা উইলিয়ামস চাঁদ থেকে ফিরে এসে হিন্দু থেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন।
এখানে উদাহরণ স্বরূপ কিছু প্রচারিত দাবি তুলে ধরা হলো (ইংরেজি থেকে হুবহু অনূদিত):
গুজব-১
“সুনীতা উইলিয়ামস (প্রথম ভারতীয় নারী যিনি মহাশূন্য অভিযানে কয়েক মাস আগে গিয়েছিলেন) ইসলাম গ্রহণ করেছেন, মাশাল্লাহ। কারণ তারা যখন চাঁদে ছিলেন, তারা পৃথিবীর দিকে দেখলেন, পুরো পৃথিবীকেই কালো দেখাচ্ছিল, কিন্তু পৃথিবীর বুকে দুইটি জায়গা জ্বলজ্বল করছিল আর তারা(রশ্নি)র মতো দেখাচ্ছিল। তাঁরা তা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন এবং দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে তা দেখলেন। তাঁরা জানতে পারলেন যে ওই দুটি জায়গা ছিল ‘মক্কা’ আর ‘মদিনা’ মাশাল্লাহ্। তখন তারা সিদ্ধান্ত নিলেন পৃথিবীতে ফিরে তারা ‘ইসলাম’ গ্রহণ করবেন। তাই আপনি একজন মুসলিম হিসেবে গর্ব করুন। আল্লাহ্ হাফিজ...!”
গুজব-২
“2/7/2007 তারিখে চাঁদে গমনকারী প্রথম ভারতীয় নারী সুনীতা উইলিয়ামস বলেছেন যে, চাঁদ থেকে পুরো পৃথিবীকে কালো আর অন্ধকার দেখাচ্ছিল, দুইটি জায়গা ছাড়া যা উজ্জ্বল আর রশ্মিময় ছিল, যখন তিনি দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে তা দেখছিলেন। এই জায়গা দুটি ছিল মক্কা আর মদিনা (সৌদি আরব)। আর এই চাঁদে সকল তরঙ্গই যখন নিষ্ক্রিয়, তবুও তিনি আযানের ধ্বনি শুনতে পেয়েছিলেন... শ’আল্লাহ্।”
গুজব-3
“মুসলমানদের জন্য উদ্দীপক সংবাদ... মহাশূন্যের অভিযাত্রী সুনীতা উইলিয়ামস ইসলাম গ্রহণ করেছেন। কারণ যখন তাঁরা মহাশূন্যে ছিলেন পুরো পৃথিবীকেই অন্ধকার দেখাচ্ছিল কিন্তু পৃথিবীর মাত্র দুটি জায়গা জ্বলজ্বল করছিল। টেলিস্কোপিক দৃষ্টিতে তারা জায়গাদুটিকে মক্কা এবং মদিনা বলে নির্দিষ্ট করেন; আর পৃথিবীতে পৌছে ইসলাম গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আলহামদুলিল্লাহ্ সর্বশক্তিমান তাদেরকে নিরাপদে ফিরিয়ে এনেছেন। তাই সুবহানাল্লাহ, একজন মুসলিম হিসেবে গর্বিত হোন।”
গুজবের অযথার্থতাঃ
প্রথমত দৈনিক কালের কণ্ঠের প্রতিবেদন সম্পর্কে বলতে গেলে সত্যতা সেখানে নেই বললেই চলে। শুধুমাত্র সুনীতার ব্যক্তিগত তথ্যগুলি সত্য। ওমরাহ পালন বিষয়ে তথ্যগুলো পুরোটাই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। কোন তথ্যসূত্র, দিন-তারিখ কিছুই উল্লেখ নেই। সুনীতার মা-বাবা উভয়কেই হিন্দু বলা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সুনীতার মা একজন ক্যাথলিক। মহাকাশে গিয়ে রেকর্ড পরিমাণ সময় ১৯ ঘণ্টা ১৭ মিনিট স্পেস ওয়ার্ক করার কথা বলা হয়েছে, অথচ সুনীতা সেখানে 195 দিন অবস্থান করে কাজ করেছেন। আর সাংবাদিকদের কাছে তাঁর এই বক্তব্যের কোন প্রমাণ বা প্রকাশনা নেই। আসলে উক্ত প্রতিবেদনে ধর্ম প্রচারকরা নিজেদের কথাগুলো সুনীতার মুখ দিয়ে অত্যন্ত কৌশলে বলিয়ে নিচ্ছেন যা গতানুগতিক বাক্য গঠনশৈলী দেখেই বোঝা যায়।
সুনীতা আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে গিয়েছিলেন, চাঁদে নয়। মানুষের সর্বশেষ চাঁদে অবতরণ হয়েছিল 1972 সালের 7 ডিসেম্বর (এপোলো 17)। আজ পর্যন্ত ইউজিন কারনেনই শেষ নভোযাত্রী যিনি চাঁদের বুকে হেটেছিলেন। আর চাঁদের বুকে বাতাসও নেই যে সেখানে আযান শোনা যাবে।
সুনীতা উইলিয়ামস প্রথম ভারতীয় নারী নভোযাত্রী নন। ইন্দো-আমোরিকান নভোযাত্রী কল্পনা চাওলা ছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রথম নারী যিনি মহাশূন্য অভিযানে গিয়েছিলেন।
গুজবগুলো দাবি করে, তাঁরা পৃথিবীতে ফিরে এসে ইসলাম গ্রহণ
করবেন। প্রকৃতপক্ষে তাঁরা তা করেননি। বরং আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে যাওয়ার সময় উইলিয়ামস তাঁর সঙ্গে এক কপি ভগবদ্ গীতা ও ভগবান গণেশের ছোট একটি মূর্তি নিয়ে গিয়েছিলেন। 2007 সালের 22 জুন পৃথিবীতে ফিরে তিনি ইসলাম গ্রহণ বিষয়ে কোন লক্ষণই প্রদর্শন করেননি। বস্তুত, তিনি বিশ্বাস করেন ভগবান গণেশ, আল্লাহ নয়, সবসময় তাঁর সহায় ছিলেন।
পৃথিবীতে অবতরণের প্রায় চার মাস পরে 15 অক্টোবর 2007 তারিখে ভারতের অন্যতম প্রভাবশালী পত্রিকা ইন্ডিয়া টুডে পত্রিকায় তাঁর সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “Up in space, the Gita and Ganesha were what kept me grounded. They put life in perspective.”
তিনি মহাশূন্যে সঙ্গী হিসেবে ভগবান গণেশ আর ভগবদ গীতাকেই বেছে নিয়েছিলেন। এর পূর্বে তিনি এতটা গভীরভাবে কখনো গীতা অধ্যয়ন করেননি। যদিও কৈশোর বয়সে তাঁর বাবা তাকে রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনী শুনিয়েছিলেন। তিনি বলেন, “এটাকে মামুলি মনে হতে পারে, কিন্তু এটাই তোমার প্রকৃত ভিত্তি। পৃথিবীর চারদিকে ঘূর্ণায়মান ছোট একটা নভোযান, তুমি অনেক কিছুই করছ, মাঝে মাঝে এটাকে কাজ বলেই মনে হয়, যা তুমি করছ... গণেশ, গীতা সত্যি সত্যিই তোমাকে যেন গৃহে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। অর্জুনের বিষাদ আর জিজ্ঞাসা বিষয়ে পড়তে গেলে রোমাঞ্চিত হতে হয়। আর এটাই তোমার জীবনকে গভীরতা প্রদান করে।”
মুসলমান হওয়ার গল্প-১ :
নাসার নভোচারী সুনিতা এখন মুসলমান
২০০৬ সালের কথা। বরাবরের মতো মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা থেকে একটি নভোযান পাঠানো হলো। মহাকাশের খোঁজখবর সংগ্রহ করাই ছিল যে অভিযানের মূল উদ্দেশ্য। অন্য গবেষকদের সঙ্গে সে নভোযানে অবস্থান করছিলেন সুনিতা উইলিয়াম। মহাকাশ গবেষণাযানটি যখন পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে ২৪০ মাইল উপরে, হঠাৎ নিচের দিকে চোখ আটকে যায় সুনিতার। পৃথিবী পৃষ্ঠে তারার মতো দুটি আলো জ্বলতে দেখলেন তিনি। চিন্তায় পড়ে গেলেন সুনিতা; ভাবলেন, পৃথিবীপৃষ্ঠে তো এভাবে জ্বলে থাকার মতো কোনো আলোকশিখা থাকার কথা নয়। তবে এই আলোকরশ্মি দুটি কি?
সঙ্গীদের ডেকে দেখালেন এবং টেলিস্কোপের সাহায্যে আলো দুটিকে নির্ণয় করার চেষ্টা চালালেন। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো সুনিতার। আরো কাছে, আরো পরিষ্কারভাবে দেখলেন, আলো দুটির কেন্দ্রস্থল পৃথিবীর মক্কা ও মদিনা। মক্কা শহরের কেন্দ্রস্থল ও মদিনা শহরের কেন্দ্রস্থ থেকে মহাকাশমুখি এই আলোকরশ্মি দুটি বিকিরিত হচ্ছে।
মহাকাশ অঙ্গনে ঘটে যাওয়া এই ঘটনা সম্পর্কে সুনিতা উইলিয়াম নিজেই বলেছেন, 'আমি যখন পৃথিবী থেকে প্রায় ২৪০ মাইল উপরে উঠলাম, তখন পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে পৃথিবীপৃষ্ঠে দুটি তারা (আলো) দেখতে পেলাম। এর পর একটি টেলিস্কোপের মাধ্যমে আলো দুটি দেখার চেষ্টা করলে দেখি, একটি আলোর অবস্থান মক্কায় আর অন্যটি মদিনায়। এই দৃশ্য দেখার পর আমি প্রচণ্ডভাবে অভিভূত হই এবং তখনই ইসলাম গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিই। পরে ফিরে এসে ইসলাম গ্রহণ করি। আমি এখন একজন মসলমান।'
ইসলাম গ্রহণ করা নিয়ে শত জল্পনা-কল্পনার ইতি টেনে ওমরাহ পালন করতে আসা সুনিতা উইলিয়াম জেদ্দার হোটেল হিলটনে বসে এভাবেই ব্যক্ত করছিলেন তাঁর ইসলাম গ্রহণ করার কাহিনী। সাংবাদিকদের শোনাচ্ছিলেন তাঁর মুসলমান হওয়ার রোমাঞ্চকর গল্প। এ সময় তিনি ইসলাম গ্রহণ করার নেপথ্যে থাকা ঘটনা ব্যক্ত করার পাশাপাশি উপস্থিত সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নেরও উত্তর দেন। নাসার প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক সুনিতার ইসলাম গ্রহণ করা বিষয়ে তাঁকে চেনেন বা জানেন এমন অনেকের মন্তব্য ছিল অনেকটাই এরকম- 'আর কারো পক্ষে সম্ভব হলেও সুনিতার পক্ষে এটা কখনো সম্ভব নয়।
কারণ সে ছিল ইসলাম বিদ্বেষী'। অবশেষে সব জল্পনা-কল্পনা এবং সন্দেহ-কানাকানির ইতি টেনে গত রমজান মাসে ওমরাহ পালন করতে এসে নিজের মুসলমান হওয়ার ঘোষণা দিলেন সুনিতা উইলিয়াম এবং গর্ব করে বললেন, 'আমি এখন একজন মুসলমান, এটা ভাবতেই আমার ভালো লাগছে।'
ভারতীয় বংশোদ্ভূত সুনিতা উইলিয়াম ১৯৬৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ায়ো অঙ্গরাজ্যের 'ইউক্লিডে' জন্মগ্রহণ করেন। বাবা দীপক পাণ্ডে ও মা বনি পাণ্ডে উভয়ই ছিলেন ভারতীয় হিন্দু। ম্যাসাচুসেটস হাই স্কুলে পড়াশোনা করার পর ১৯৮৭ সালে ফিজিক্যাল সায়েন্সে বিএস ডিগ্রি এবং ১৯৯৫ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজমেন্ট ফ্লোরিডা ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে এমএস ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। এর আগে ১৯৮৯ সালে সুনিতা ন্যাভাল একাডেমীতে কমিশন লাভ করেন এবং ১৯৯৩ সালে ন্যাভাল এভিয়েটর হিসেবে পদোন্নতি অর্জন করেন। পরবর্তী সময়ে আমেরিকান হেলিকপ্টার ইনস্টিটিউটে টেস্ট পাইলট ইঞ্জিনিয়ারের দায়িত্ব পালনকালে ভূমধ্যসাগর, লোহিত সাগর, পারস্য ও আরবসাগরসহ মরুভূমি এলাকায় কাজ করেন। এর পর ১৯৯৮ সালে সুনিতা ফ্লোরিডাস্থ মার্কিন মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র নাসায় যোগদান করেন। কর্মরত অবস্থায়ই একজন ক্যাথলিক খৃস্টানকে বিয়ে করে সংসারজীবনে প্রবেশ করেন তিনি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন সময়, বিশেষ করে আরবের মরু এলাকায় কাজ করার সময় অল্প-বিস্তর ধারণা অর্জন করেন মুসলমানদের প্রকৃত জীবন সম্পর্কে। উল্লেখ্য, এর আগে ইসলাম সম্পর্কে সুনিতার বস্তুত কোনো ধারণা বা পড়াশোনা ছিল না।
নভোযান পরিচালনার ক্ষেত্রে খুব দক্ষ কর্মী ছিলেন সুনিতা উইলিয়াম। মহাকাশে গিয়ে রেকর্ড পরিমাণ সময় ১৯ ঘণ্টা ১৭ মিনিট স্পেস ওয়ার্ক করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে নিঃসন্তান সুনিতা সেদিন সবার সামনে স্পষ্ট ভাষায় বলেন, 'আমি একজন মুসলমান। আমার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা নিয়ে এতদিন যে সন্দেহ চলে আসছিল, আজ তার অবসান হলো। বর্তমানে আমি একজন মুসলমানের মতোই জীবন যাপন করছি। আমার ইসলাম গ্রহণ করার ব্যাপারে আর কোনো বিভ্রান্তি ছড়ানোর উপায় নেই।
প্রতিবেদক: মিরাজ রহমান (ইমেইল: mirajrahmanbd@gamil.com)
প্রকৃতপক্ষে এই প্রতিবেদন হচ্ছে ইন্টারনেট ভিত্তিক অপপ্রচারের ফসল। ইন্টারনেটে কি কি অপপ্রচার হচ্ছে সুনীতাকে ঘিরে? ইন্টারনেট ভিত্তিক মুসলমানদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্যবহুল ওয়েবসাইট উইকিইসলাম ডটনেট হতে এবিষয়ে হুবহু বিবরণটা এই রকমঃ
বিভিন্ন ওয়েবসাইট, ব্লগ, ফোরাম এবং চেইন ইমেইল বা গণ-মুঠোবার্তায় প্রচারণায় দাবি জানানো হয়েছে যে সুনীতা উইলিয়ামস চাঁদ থেকে ফিরে এসে হিন্দু থেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন।
এখানে উদাহরণ স্বরূপ কিছু প্রচারিত দাবি তুলে ধরা হলো (ইংরেজি থেকে হুবহু অনূদিত):
গুজব-১
“সুনীতা উইলিয়ামস (প্রথম ভারতীয় নারী যিনি মহাশূন্য অভিযানে কয়েক মাস আগে গিয়েছিলেন) ইসলাম গ্রহণ করেছেন, মাশাল্লাহ। কারণ তারা যখন চাঁদে ছিলেন, তারা পৃথিবীর দিকে দেখলেন, পুরো পৃথিবীকেই কালো দেখাচ্ছিল, কিন্তু পৃথিবীর বুকে দুইটি জায়গা জ্বলজ্বল করছিল আর তারা(রশ্নি)র মতো দেখাচ্ছিল। তাঁরা তা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন এবং দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে তা দেখলেন। তাঁরা জানতে পারলেন যে ওই দুটি জায়গা ছিল ‘মক্কা’ আর ‘মদিনা’ মাশাল্লাহ্। তখন তারা সিদ্ধান্ত নিলেন পৃথিবীতে ফিরে তারা ‘ইসলাম’ গ্রহণ করবেন। তাই আপনি একজন মুসলিম হিসেবে গর্ব করুন। আল্লাহ্ হাফিজ...!”
গুজব-২
“2/7/2007 তারিখে চাঁদে গমনকারী প্রথম ভারতীয় নারী সুনীতা উইলিয়ামস বলেছেন যে, চাঁদ থেকে পুরো পৃথিবীকে কালো আর অন্ধকার দেখাচ্ছিল, দুইটি জায়গা ছাড়া যা উজ্জ্বল আর রশ্মিময় ছিল, যখন তিনি দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে তা দেখছিলেন। এই জায়গা দুটি ছিল মক্কা আর মদিনা (সৌদি আরব)। আর এই চাঁদে সকল তরঙ্গই যখন নিষ্ক্রিয়, তবুও তিনি আযানের ধ্বনি শুনতে পেয়েছিলেন... শ’আল্লাহ্।”
গুজব-3
“মুসলমানদের জন্য উদ্দীপক সংবাদ... মহাশূন্যের অভিযাত্রী সুনীতা উইলিয়ামস ইসলাম গ্রহণ করেছেন। কারণ যখন তাঁরা মহাশূন্যে ছিলেন পুরো পৃথিবীকেই অন্ধকার দেখাচ্ছিল কিন্তু পৃথিবীর মাত্র দুটি জায়গা জ্বলজ্বল করছিল। টেলিস্কোপিক দৃষ্টিতে তারা জায়গাদুটিকে মক্কা এবং মদিনা বলে নির্দিষ্ট করেন; আর পৃথিবীতে পৌছে ইসলাম গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আলহামদুলিল্লাহ্ সর্বশক্তিমান তাদেরকে নিরাপদে ফিরিয়ে এনেছেন। তাই সুবহানাল্লাহ, একজন মুসলিম হিসেবে গর্বিত হোন।”
গুজবের অযথার্থতাঃ
প্রথমত দৈনিক কালের কণ্ঠের প্রতিবেদন সম্পর্কে বলতে গেলে সত্যতা সেখানে নেই বললেই চলে। শুধুমাত্র সুনীতার ব্যক্তিগত তথ্যগুলি সত্য। ওমরাহ পালন বিষয়ে তথ্যগুলো পুরোটাই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। কোন তথ্যসূত্র, দিন-তারিখ কিছুই উল্লেখ নেই। সুনীতার মা-বাবা উভয়কেই হিন্দু বলা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সুনীতার মা একজন ক্যাথলিক। মহাকাশে গিয়ে রেকর্ড পরিমাণ সময় ১৯ ঘণ্টা ১৭ মিনিট স্পেস ওয়ার্ক করার কথা বলা হয়েছে, অথচ সুনীতা সেখানে 195 দিন অবস্থান করে কাজ করেছেন। আর সাংবাদিকদের কাছে তাঁর এই বক্তব্যের কোন প্রমাণ বা প্রকাশনা নেই। আসলে উক্ত প্রতিবেদনে ধর্ম প্রচারকরা নিজেদের কথাগুলো সুনীতার মুখ দিয়ে অত্যন্ত কৌশলে বলিয়ে নিচ্ছেন যা গতানুগতিক বাক্য গঠনশৈলী দেখেই বোঝা যায়।
সুনীতা আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে গিয়েছিলেন, চাঁদে নয়। মানুষের সর্বশেষ চাঁদে অবতরণ হয়েছিল 1972 সালের 7 ডিসেম্বর (এপোলো 17)। আজ পর্যন্ত ইউজিন কারনেনই শেষ নভোযাত্রী যিনি চাঁদের বুকে হেটেছিলেন। আর চাঁদের বুকে বাতাসও নেই যে সেখানে আযান শোনা যাবে।
সুনীতা উইলিয়ামস প্রথম ভারতীয় নারী নভোযাত্রী নন। ইন্দো-আমোরিকান নভোযাত্রী কল্পনা চাওলা ছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রথম নারী যিনি মহাশূন্য অভিযানে গিয়েছিলেন।
গুজবগুলো দাবি করে, তাঁরা পৃথিবীতে ফিরে এসে ইসলাম গ্রহণ
পৃথিবীতে অবতরণের প্রায় চার মাস পরে 15 অক্টোবর 2007 তারিখে ভারতের অন্যতম প্রভাবশালী পত্রিকা ইন্ডিয়া টুডে পত্রিকায় তাঁর সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “Up in space, the Gita and Ganesha were what kept me grounded. They put life in perspective.”
তিনি মহাশূন্যে সঙ্গী হিসেবে ভগবান গণেশ আর ভগবদ গীতাকেই বেছে নিয়েছিলেন। এর পূর্বে তিনি এতটা গভীরভাবে কখনো গীতা অধ্যয়ন করেননি। যদিও কৈশোর বয়সে তাঁর বাবা তাকে রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনী শুনিয়েছিলেন। তিনি বলেন, “এটাকে মামুলি মনে হতে পারে, কিন্তু এটাই তোমার প্রকৃত ভিত্তি। পৃথিবীর চারদিকে ঘূর্ণায়মান ছোট একটা নভোযান, তুমি অনেক কিছুই করছ, মাঝে মাঝে এটাকে কাজ বলেই মনে হয়, যা তুমি করছ... গণেশ, গীতা সত্যি সত্যিই তোমাকে যেন গৃহে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। অর্জুনের বিষাদ আর জিজ্ঞাসা বিষয়ে পড়তে গেলে রোমাঞ্চিত হতে হয়। আর এটাই তোমার জীবনকে গভীরতা প্রদান করে।”
No comments:
Post a Comment